আজকের ওয়েবকে আমরা যেভাবে দেখি, তার পেছনে রয়েছে কিছু প্রযুক্তির নিরলস অবদান। এদের মধ্যে জাভাস্ক্রিপ্ট (JavaScript) নিঃসন্দেহে অন্যতম। একসময় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW) কেবল হাইপারলিঙ্ক দ্বারা সংযুক্ত স্ট্যাটিক পেজের সমষ্টি ছিল। কিন্তু ব্যবহারকারীরা দ্রুতই আরও বেশি মিথস্ক্রিয়া এবং গতিশীলতার দাবি তুলতে শুরু করেন। আর এই চাহিদা মেটাতেই জন্ম হয় জাভাস্ক্রিপ্টের, যা ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণ নতুন এক মাত্রা দেয়।

জন্মের প্রেক্ষাপট: নেটসকেপ এবং ব্রেন্ডান আইচ

১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওয়েব ব্রাউজার বাজারে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, বিশেষত নেটসকেপ (Netscape) এবং মাইক্রোসফ্ট (Microsoft) এর মধ্যে। নেটসকেপ, একটি অগ্রণী ব্রাউজার বিক্রেতা হিসেবে, তাদের নেভিগেটর ব্রাউজারের জন্য দ্রুত একটি নতুন স্ক্রিপ্টিং ভাষা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। উদ্দেশ্য ছিল ওয়েব পেজগুলোকে আরও ইন্টারেক্টিভ করে তোলা।

এই কঠিন কাজটি মাত্র ১০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়ে নেটসকেপের মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার ব্রেন্ডান আইচ (Brendan Eich) এর কাঁধে। এটি ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, কিন্তু আইচ সফলভাবে একটি প্রোটোটাইপ স্ক্রিপ্টিং ভাষা তৈরি করেন। এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি AWK, জাভা (Java), পার্ল (Perl), স্কিম (Scheme), হাইপারটক (HyperTalk) এবং অটো (Self) এর মতো বিভিন্ন ভাষা থেকে ধারণার উপাদান গ্রহণ করেন। এটি সত্যিই একটি চিত্তাকর্ষক কৃতিত্ব ছিল, তবে দ্রুত কাজ করার কারণে প্রথমদিকে এতে কিছু ত্রুটি (quirks) এবং বাগ ছিল, যা শেষ পর্যন্ত ভাষাটিকে পুরোপুরি পরিমার্জিত হতে দেয়নি।

নামকরণ এবং বিভ্রান্তি

নতুন এই ভাষাটির প্রাথমিক নাম ছিল “মোচা” (Mocha)। কিন্তু খুব দ্রুতই এর নাম পরিবর্তন করে “লাইভস্ক্রিপ্ট” (LiveScript) রাখা হয়। এরপর এটিকে আবার “জাভাস্ক্রিপ্ট” (JavaScript) নামে রিব্র্যান্ড করা হয়। এই নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল সে সময়ে সান মাইক্রোসিস্টেমসের (Sun Microsystems) জনপ্রিয় জাভা ভাষার প্রচার থেকে সুবিধা লাভ করা।

তবে, এই নামকরণের কারণে একটি বড় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেকেই জাভাস্ক্রিপ্টকে জাভার একটি হালকা সংস্করণ মনে করতেন, যা সম্পূর্ণ ভুল। যদিও জাভাস্ক্রিপ্টের সিনট্যাক্সে জাভার সাথে কিছু মিল রয়েছে, দুটি ভাষা সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন এবং ভিন্ন উদ্দেশ্যে তৈরি।

আত্মপ্রকাশ এবং মাইক্রোসফ্টের JScript

জাভাস্ক্রিপ্ট ১৯৯৫ সালে নেটসকেপের নেভিগেটর ব্রাউজারের সংস্করণ-২ (Version-2) এর সাথে আত্মপ্রকাশ করে। এর দ্রুত জনপ্রিয়তা মাইক্রোসফ্টকে নড়েচড়ে বসায়। পরের বছরই মাইক্রোসফ্ট জাভাস্ক্রিপ্টকে রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং করে তাদের নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করে। সান মাইক্রোসিস্টেমসের সাথে কপিরাইট সমস্যা এড়াতে এবং জাভা ট্রেডমার্কের মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে তারা এর নাম দেয় “JScript”।

JScript ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার (Internet Explorer) এর সংস্করণ-৩ (Version-3) এর সাথে যুক্ত ছিল। এটি জাভাস্ক্রিপ্টের প্রায় অনুরূপ ছিল, এমনকি এর বাগ এবং ত্রুটিগুলোও বিদ্যমান ছিল। তবে JScript-এ ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের জন্য কিছু অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যও যোগ করা হয়েছিল। একই সময়ে মাইক্রোসফ্ট VBScript নামে আরও একটি স্ক্রিপ্টিং ভাষাও ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের জন্য ব্যবহার করতো।

জনপ্রিয়তা এবং চ্যালেঞ্জ

জাভাস্ক্রিপ্ট (এবং JScript) দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এটি শেখা সহজ ছিল এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টে প্রবেশ করার জন্য একটি কম বাধা তৈরি করেছিল। এর ফলস্বরূপ, ওয়েব পেজগুলোকে গতিশীল এবং আরও ইন্টারেক্টিভ করার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।

তবে, এর সহজলভ্যতা একটি অভিশাপও হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই সঠিকভাবে না বুঝে কোড লেখা শুরু করেন, যার ফলে ইন্টারনেটে অনেক নিম্নমানের এবং ভুলভাবে ব্যবহৃত জাভাস্ক্রিপ্ট কোডের উদাহরণ ছড়িয়ে পড়ে। কোড সহজেই কপি করা যেত, কিন্তু প্রায়শই তা ভুল প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হতো, যা সামগ্রিকভাবে ওয়েব কোয়ালিটির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

উপসংহার

ব্রেন্ডান আইচের ১০ দিনের এই প্রজেক্টটি ওয়েবের ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। যদিও এর শুরুটা ছিল কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ, জাভাস্ক্রিপ্ট নিজেকে প্রতিনিয়ত বিকশিত করে আজ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামিং ভাষাগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমেই ওয়েব স্ট্যাটিক অবস্থা থেকে ইন্টারেক্টিভ এবং ডায়নামিক এক প্লাটফর্মে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আমাদের আধুনিক ডিজিটাল জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *